করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকায় গত ৫ এপ্রিল থেকে দেশে দ্বিতীয় দফায় কঠোর বিধিনিষেধ (লকডাউন) জারি হয়েছে। আগামী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত এই লকডাউনের মেয়াদ বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে সরকার। দীর্ঘমেয়াদি এই লকডাউনে গভীর সঙ্কটে পড়েছেন মুচি থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। নিম্ন আয়ের মানুষ তিনবেলা দু-মুঠো ভাত যোগাতেও হিমশিম খাচ্ছেন।
অন্যদিকে গত লকডাউনের প্রভাব কিছুটা কাটিয়ে না উঠতেই নতুন করে লকডাউনে পড়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে আছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা। সার্বিকভাবে ভয়াবহ সঙ্কটে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ।
এদিকে গত বছর লকডাউনে নানা ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করলেও এবার তেমন উদ্যোগও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। হতদরিদ্ররাও সরকারের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত তেমন সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলেও তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। লকডাউনে পড়ে সৃষ্ট দুর্ভোগ-কষ্টের কথা রাজধানীর নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে শুনেছে সংবাদ জগৎ।
কেউ বলেছেন চরম অর্থকষ্টের কথা, কেউ বলেছেন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা। কেউ আবার স্বপ্ন সাজানোর পথে হোঁচট খাওয়ার কথা বলতে গিয়ে হয়েছেন আবেগতাড়িত।
লকডাউনের কারণে আগের মতো ভাড়া মিলছে না, বলছেন রিকশাচালকরা ‘মাত্র ২০ টাকা কামাইছি, দুপুরে খাওয়াও সম্ভব নয়’ স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে ভাড়া বাসায় রাজধানীতেই থাকেন মহেশ দাস। মিরপুর ১০ নম্বর মোড়ে জুতা রং ও সেলাইয়ের কাজ করেন তিনি। কিন্তু লকডাউনে পরিবার নিয়ে বেশ বিপাকে আছেন। একদিকে যেমন দোকান খুলে ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না, অন্যদিকে তেমন কাজও পাচ্ছেন না। দিনশেষে ৪০ থেকে ৫০ টাকার বেশি ঘরে তুলতে পারছেন না বলে জানান মহেশ।এতে অনেকটা অর্ধাহারে পরিবার নিয়ে দিনাতিপাত করছেন তিনি।
গত শুক্রবার (১৬ এপ্রিল) বিকেল ৩টার দিকে মহেশ সংবাদ জগৎ কে বলেন, ‘সকালে রুটি আর ভাজি খেয়ে বাইর হইছি। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় পানি নিয়ে আসছি। সেই পানি খেয়েই এখনো আছি। লকডাউন বহুত কষ্টের মধ্যে ফেলে দিছে। সকাল থেকে পুলিশ তিনবার উঠাই দিছে, তারপরও আইসা বসছি। বইসা ১০ টাকা ১০ টাকা, মোট ২০ টাকার কাজ করলাম। এখন আমি যে দুপুরে কিছু খাবো, ওইটাও আর সম্ভব না।’
মিরপুর ১০ নম্বর মোড়ে ফলের দোকান চালান রেজাউল শেখ। তার ভাষ্য লকডাউনে ব্যবসা নেই তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাই নাই। কষ্ট বলেই তো লকডাউনের মধ্যে কাস্টমার না থাকার পরেও এখানে বসে আছি।’ ‘দুই কার্টন আপেল, পাঁচ কেজি মাল্টা, অর্ধেক আঙুর পচে গেছে’ ঢাকায় এসে তিন সপ্তাহ আগে মিরপুর ১০ নম্বর মোড়ে ফলের দোকান দিয়েছেন মো. রেজাউল শেখ। প্রথম সপ্তাহ লাভের মুখ দেখলেও দুই সপ্তাহ ধরে বিক্রি কম, এর মধ্যে আবার কিছু মালামালে পচন ধরেছে। এতে লোকসানের মুখে পড়েছেন তিনি।
রেজাউল শেখ বলেন, ‘নিয়মিত দোকান করতে পারি না। সকাল ১০টায় খুলি, বিকেল ৩টায় বন্ধ করে ফেলতে হয়। ৩টার উপরে গেলে পুলিশ ধাওয়া দেয়। কাঁচামাল তো পচে যায়। টেনশনে থাকি। এই তিনদিনে দুই কার্টন আপেল ফেলছি। মাল্টা পাঁচ কেজির মতো ফেলে দিছি। আর আঙুর গেছে প্রায় অর্ধাঅর্ধি। আঙুর বেশি পচে। তারপর থেকে আর আঙুর আনি না। সবমিলিয়ে আমার প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকার মাল পচে গেছে।’
অনেক রিকশাচালকের অভিযোগ, লকডাউনে প্রায়ই তাদের রিকশার গদি নিয়ে যান পুলিশ কর্মকর্তারা তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের আইন তো মানতে অইবো। কিন্তু পেটতো আর মানে না। কিস্তি, বাসা ভাড়া এগুলো তো আর মানবো না। নিজের একটা খরচ আছে। গ্রামের বাড়িতে থাকা বউ-বাচ্চাদের জন্য টাকা পাঠাতে হচ্ছে। অথচ ব্যবসায় লাভ নাই, বরং ক্ষতির মধ্যে আছি। সবমিলিয়ে বর্তমানে একটু কষ্টে আছি।’ ‘রিকশার গদি খুইলে রাখে, রুজি বন্ধে হয়ে যায়’ ঝিনাইদহের কালিগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে মা, বউ, এক ছেলে ও এক মেয়ে থাকে রিকশাচালক মো. মজিবরের। গত বছর জারি হওয়া প্রথম দফার লকডাউন কেটে গেলে ঢাকায় আসেন তিনি। তারপর মাত্র একবার তিনি গ্রামের বাড়িতে গেছেন। সংসার চালাতে ঢাকায় রিকশা চালিয়ে যাচ্ছেন অনবরত। লকডাউনে রিকশা চালানোর বিষয়ে মজিবর বলেন, ‘রাস্তাঘাটে গদি-মদি খুইলে রাখছে পুলিশ। অনেক সময় তো যাত্রী নামায়ে দিতেছে। খুবই কষ্টে আছি। বাড়িতে ছেলেপেলে, মা আছে। তারা রোজা থাকে। তাদের তো একটা আহার আছে। আমরা তো অইডা পারছি না দিতে। আমাদের গদি খুইলে রাখছে। আমাদের রুজিই বন্ধে হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘রিকশা চলে। কিন্তু কহন কী করছে, সেইডাই তো বলা যাচ্ছে না। কাইলকা এইরহম ১৪ নম্বর বইসে আছি, গপ কইরে মোটরসাইকেল এসে গদি খুইলে নিয়ে গেল। কী করবেন কন, কিছু করার নাই। পরে এক ঘণ্টা রাইখা আবার দিয়া দিলে। ইনকাম আছে। কিন্তু করতে তো পারছি না। ভয়ে ভয়ে এভাবে তো করা যায় না। চুরি করছি না, বদমাইশি করছি না, রুজি করবো তাও ভয়। এইডা একটা দেশ হইলো বলেন?’
দক্ষিণ মণিপুরের কুষ্টিয়া স্যালুনে কাজ করছেন মো. মুস্তাফিজ রহমান লকডাউনে অনেকে শপিংশল, দোকানপাট খুলতে পারছে না। আপনারা তো রিকশা চালাতে পারছেন। এর জবাবে মজিবর বলেন, ‘ওদের তো আছে। আমাদের তো কিছু নেই। আমাদের তো শরীরের ওপর দিয়ে চলে। আমাগে শরীরডা অচল থাকলে হাড়ি শিকেয় থাকে। শরীর চললে সংসার চলে।’ ‘রিকশা না বের করলে বাড়িতে বাপ-মা-বউ-বাচ্চা তিনবেলা খেতেও পারবে না’ গত বৃহস্পতিবার (১৫ এপ্রিল) মিরপুর ১০ নম্বর থেকে যাত্রী নিয়ে মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বরে যাচ্ছিলেন রিকশাচালক মো. ফরিদ। অল্প এগোতেই পুলিশ তার রিকশা আটকায়। যাত্রীকে নামিয়ে দিয়ে তার রিকশা উল্টিয়ে দেয়। তারপর রিকশার সিট নিয়ে চলে যায় পুলিশ। সিটের জন্য দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করেন ফরিদ। একপর্যায়ে লোকমুখে শুনতে পারেন সিট আর দেবে না পুলিশ। তারপর মহাজনের কাছে গিয়ে আরেকটি সিট নিয়ে রিকশা চালাতে বের হন ফরিদ। তিনি সংবাদ জগৎ কে বলেন, ‘মহাজন বলেন, সিটের দাম প্রায় ৫০০ টাকা। তুমি সিটটা দিয়ে চলে আইলা? মহাজন সিটের টাকা চেয়েছে, কিন্তু এখনও আমি কিছু বলিনি।