1. xsongbad@gmail.com : Harry Deb Nath : Harry Deb Nath
  2. tauhidcrt8@gmail.com : tauhidcrt8 :
সোমবার, ০৫ জুন ২০২৩, ০৪:৩৯ অপরাহ্ন
বিজ্ঞপ্তি:
  • Welcome To Our Website...* এন জি ও ‘আরবান সমিতি’ –মাইক্রো ক্রেডিট ফাইনান্সে জরুরী ভিত্তিতে কিছু সংখ্যক মহিলা/পুরুষ মাঠ কর্মী নিয়োগ দেয়া হবে। বয়স ২৫ উর্ধ্ব হতে হবে। আগ্রহী প্রার্থীদেরকে সরাসরি নিম্নোক্ত নাম্বারে যোগাযোগ করুনঃ ০১৩০১০৪১২৮৮  আমাদের অনলাইন নিউজ পোর্টালে বিজ্ঞাপন দিতে চাইলে এই নাম্বারে যোগাযোগ করুনঃ ০১৮১৫-৫৮৭৪১০

চেটেপুটে খাওয়া ভেতো জীবনে পেঁয়াজ অবিচ্ছেদ্য

প্রতিবেদকের নাম
  • আপডেটের সময় : বুধবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২০
  • ২১৪ বার ভিউ
Pic: Jugantor
টাঙ্গাইলে ‘পিঁয়াজের খ্যাপ’ বলে একটা কথা আছে। এটা সেই অগস্ত্যযাত্রা। কেউ কোথাও গিয়ে আর ফিরছে না বা তার অপেক্ষায় থেকে থেকে কেউ পেরেশান, তখন ঠোঁট বাঁকিয়ে বলবে যে ‘পিঁয়াজের খ্যাপে গেছে’। কথাটার মধ্যে ব্যঙ্গ, উষ্মা ও ক্ষোভ আছে, যা পেঁয়াজের ঝাঁজের সঙ্গে মেলে।

পেঁয়াজ জিনিসটাই অবশ্য অন্য রকম। একটা দেশি পেঁয়াজ এমনি কাঁচা খেতে গেলে কড়া ঝাঁজে কম্ম কাবার। মুড়ি বা চানাচুরের সঙ্গে কাঁচা মরিচ-তেল দিয়ে মাখিয়ে খেলে তোফা!

খাবারের স্বাদবর্ধক হিসেবে কাঁচা পেঁয়াজ এভাবেই দুনিয়াজুড়ে দেদার খাওয়া হচ্ছে। বৈশাখে যে পান্তা-ইলিশ বলে নাচি, সেখানে আস্ত দু-একটা কাঁচা পেঁয়াজ না হলে জমে?

কাবাব, মোসাল্লাম, ভাজা মাছ, শিঙাড়া, সমুচা, পুরি, কচুরি—সব খাবারে সমাদৃত পেঁয়াজ। পশ্চিমের পিৎজা-বার্গারই বলি, বাঙালির ভাজি-ভর্তার কথাই তুলি, পেঁয়াজ এখানে রাজযোটক। তাই চেটেপুটে খাওয়া ভেতো জীবনে পেঁয়াজ অবিচ্ছেদ্য।

শৈশবে দেখেছি, শীতের সময় বাড়ির মস্ত আঙিনার এক পাশে বাড়ির স্থায়ী গোমস্তাকে দিয়ে মা সারবেঁধে কিছু পেঁয়াজ রোপণ করাতেন। গোমস্তা কপাকপ কোদাল চালিয়ে অনায়াসে কাজটা সেরে ফেলত। কয়েক দিনের মধ্যে সেখানে মাটি ফুঁড়ে উদয় হতো সবুজ সতেজ সরু পাতা। সকালে শিশিরভেজা পেঁয়াজপাতায় যে সজীবতা, তা দেখার মতো। সকাল আটটা-নটার দিকে এই পেঁয়াজপাতা তুলে মা তাওয়ায় টেলে নেওয়া মরিচ আর সর্ষের তেল ডলে একটা ভর্তা বানাতেন, যার নাম ‘মরিচডলা’। সেটা একটা ‘ডলা’ বটে! দেশি পেঁয়াজপাতার টাটকা ঝাঁজ, শুকনো মরিচ আর খাঁটি সর্ষের তেলের মিশেল সৌরভে সারা উঠান ম-ম। রাতের রেখে দেওয়া কড়কড়ে ভাত আর সেদ্ধ ডিম বা টাকি মাছের ভর্তার সঙ্গে যোগ হতো এই মরিচডলা। মিঠে রোদে বসে একটা জম্পেশ খাওয়া হয়ে যেত। ভাতে আঁত লাগিয়ে থাকা বাঙালির জলোজীবনে এটা অমৃত। মাছ-মাংস-ডিমের ভুনা, দোপিঁয়াজি, ঝোল ঝোল কারি, কোনোটাই কি পেঁয়াজ ছাড়া চলে? সৈয়দ মুজতবা আলীর সুলিখিত ‘প্রবাস বন্ধু’ গল্পে ‘পেঁয়াজ-ঘিয়ের ঘন ক্বাথে সের খানেক দুম্বার মাংস’ পড়ে কার না জিবে জল আসে?

এভাবে পেঁয়াজ চিবোতে চিবোতে বড় হওয়া ভেতোরা কখন যে পেঁয়াজের কন্দে মনপ্রাণ সমর্পণ করে বসে, তা সে নিজেও টের পায় না। খাদ্যের সীমানা ছাড়িয়ে পেঁয়াজ তখন স্বাস্থ্যের আঙিনায় ঢুকে পড়ে। পেঁয়াজে ক্যালরি খুবই কম। ১০০ গ্রামে মাত্র ৪০ গ্রাম। পেঁয়াজে আছে ক্রোমিয়ামের সমৃদ্ধ মজুত। এই খনিজ উপাদান রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা ঠিক রাখতে সহায়তা করে।

ডায়াবেটিসের রোগীর জন্য পেঁয়াজ তাই উপকারী। এটি রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতেও কাজ দেয়। গলাব্যথার উপশমে গরম পানির সঙ্গে পেঁয়াজের রস ব্যবহার করতে দেখেছি। মাথার চুলের গোড়া শক্ত করার জন্য পেঁয়াজের রস লাগানোর প্রচলন রয়েছে। কথিত আছে, রোমান সম্রাট নিরো শরীর ঠান্ডা রাখতে পেঁয়াজের রস গায়ে মাখতেন। ইতিহাসে আরও রয়েছে পণ্য বিনিময়ে পেঁয়াজের ব্যবহারের কথা। পেঁয়াজের বিনিময়ে প্লাস্টিক আর লোহার পুরোনো জিনিস নেওয়ার প্রচলন এ যুগেও আছে। মধ্যযুগে মিসরের রাজা-বাদশাহরা পেঁয়াজের মালা ব্যবহার করতেন। গ্রামাঞ্চলে সর্দি-কাশিতে পেঁয়াজ আর সর্ষের তেলের ব্যবহারও লক্ষণীয়।

পেঁয়াজের এই কাসুন্দি ঘাঁটার প্রয়োজনটা পড়েছে এমন এক সময়, দেশজুড়ে যখন দেশি পেঁয়াজের বড়ই আক্রা। নগর বা গ্রামীণ জীবনে ঘরকন্নার নিত্য অনুষঙ্গ হিসেবে এই গোল্লা বস্তুটি এতই জীবনঘনিষ্ঠ যে এর দাম কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকার বেশি মেনে নেওয়া যায় না। তবু দেড়-দুই বছর ধরে ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।

কিন্তু পেঁয়াজের দাম বেয়াড়া স্পিন বলের মতো কেজিতে শতেক টাকার ঘূর্ণি তুললে গায়ে লাগে বৈকি। দামটা আবার সুতায় বাঁধা লারেলাপ্পা চাকতির মতো ওঠানামা করে। সে ওঠানামায় নুন আনতে পান্তা ফুরানো মানুষের অবস্থা জেরবার।

প্রাকৃতিক প্রতিকূলতায় পেঁয়াজের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবং চাহিদা ও প্রাপ্তিতে সংকটের কারণে ঘাটতি পূরণ হয় আমদানিতে। মাঝে ফায়দা লোটেন মজুতদারেরা। এ নিয়ে হইচই যতই হোক, কোপটা পড়ে সাধারণের ঘাড়েই। পরিস্থিতি দাঁড়ায় লেজেগোবরে। কার গোয়ালে কে দেবে ধোঁয়া? শেষে যাও, অন্য দেশে গিয়ে ধরনা দাও।

মূল ভরসা প্রতিবেশী। সেখানেও ফ্যাঁকড়া। কদিন আগে ভারত ফট করে বলে দিল পেঁয়াজ দেবে না। অমনি রাতারাতি পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি শতের ঘরে। গত বছর এই সেপ্টেম্বরেই পেঁয়াজ ৩০০ টাকা কেজি দরে কিনতে হয়েছে।

তাই কেউ কেউ ভাবলেন যে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকানোর আগেই শত টাকার কিছু পেঁয়াজ ঘরে তুলে রাখা যাক। কাঁচাবাজারের ফর্দ কাটছাঁট করে পাঁচ-দশ কেজি ঘরে তুলে রাখলেন। কিন্তু শিগগিরই ভারত মত পাল্টে আবার রপ্তানিতে ফিরে এল। শাঁ করে পেঁয়াজ নেমে এল ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজিতে। এখন তো আরও কম। অনলাইনে টিসিবির পেঁয়াজ ৩৬ টাকা কেজিতে বিকোচ্ছে। যাঁরা পেঁয়াজ কিনে রেখেছেন, তাঁদের উশুলে ত্রিশূল।

পেঁয়াজ এখন আসছে টনকে টন। মিয়ানমার থেকে এর মধ্যে পেঁয়াজ এসেছে। হিলি, ভোমরা ও সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে আসছে ট্রাককে ট্রাক। শিগগিরই নানা রূপে নানা রকম হাজার হাজার টন পেঁয়াজে সয়লাব হয়ে যাবে বাজার। গত বছর এই সময় মিসর ও তুরস্ক থেকে আসা ঢাউস সাইজের পেঁয়াজ কাঁচাবাজারের ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে। একটা-দুটোতে এক কেজি হয়, এমন পেঁয়াজ মানুষ কিনছেও। কিন্তু এসব পেঁয়াজ সালাদ হিসেবে খেতে যতটা মজা, রান্নার উপকরণ হিসেবে তেমন উপাদেয় নয়। মিষ্টি মিষ্টি স্বাদ, গন্ধই নেই! আর সেই দেশি ঝাঁজ কোথায়?

পণ্যের দুষ্প্রাপ্যতা মানুষকে বিকল্প খুঁজতে শেখায়। একটা হারিয়ে গেলে আরেকটায় অভিযোজিত হয় মানুষ। দেশি পেঁয়াজের উৎপাদন যত ব্যাহত হবে, চাহিদায় তত সংকট তৈরি হবে। ঘাটতি পূরণে বাড়বে আমদানিনির্ভরতা। তখন দেশে চাষাবাদে কদর বাড়বে প্রতিকূলতায় অধিক টেকসই এবং উচ্চ ফলনশীল উন্নত জাতের পেঁয়াজের। কোণঠাসা হবে দেশি। আমাদের এই চামড়া আবার মা-মাটির মতো সর্বংসহা, তাই সবই একসময় গা সওয়া হয়ে যাবে। দেশি পেঁয়াজ তখন হয়তো নিজেই চলে যাবে তথাকথিত সেই ‘পিঁয়াজের খ্যাপে’।

অনেকেরই হয়তো মনে আছে সেই স্মৃতি, যখন নব্বইয়ের দশকের একটা সময় দেশের নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ে মাছের মড়ক লেগেছিল। মাথায় একধরনের ঘা নিয়ে মরে যাচ্ছিল মাছগুলো। একপর্যায়ে দেখা দিয়েছিল মাছের তীব্র সংকট। পানিতে ভরো ভরো নদীতে মাছ নেই। টইটম্বুর বিলে নেই মীনের খলবল।

সে সময় বিদেশ থেকে নধর দেহ নিয়ে প্রমাণ সাইজের কই-মাগুর আসতে শুরু করে। সেগুলোর উৎপাদনে ঝাঁপিয়ে পড়েন মৎস্যচাষিরা। এসব মাছ পুকুর-জলাশয়ে থাকা নিরীহ দেশি মাছের ভুষ্টিনাশ করে ছাড়ে। সেই খাঁটি দেশি মাছের আকাল কিন্তু এখনো আছে। বাজারে হৃষ্টপুষ্ট পাঙাশ, পাবদা-বেলের অভাব নেই। শুধু খাঁটি দেশি মাছের অভাব। দেশি মুরগায়ও তাই। কোনটা দেশি আর কোনটা যে সংকর, বোঝা দায়। বর্তমান সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে তেমনি দেশি পেঁয়াজও চুপিসারে আমাদের টা টা জানাতে পারে।

তখন দেশি পেঁয়াজের স্বাদে তুষ্ট কিছু মানুষ স্মৃতিকাতর হয়ে নাক টেনে চেষ্টা করবে পুরোনো সেই ঝাঁজে মজে থাকতে। তবে তা কেবলই হবে স্বপ্নবিলাস। সে সময় সুপারশপ বা কোনো অনলাইন শপিংয়ে হয়তো আমন্ত্রণ থাকবে দেশি পেঁয়াজ কেনার; এখন যেমন কিছু অনলাইন শপিংয়ে বিলুপ্ত ঢেঁকিছাঁটা চাল কেনার বিজ্ঞাপন থাকে।

পেঁয়াজ নিয়ে একটি ধাঁধা আছে—বাজার থেকে এলেন সাহেব কোট-প্যান্ট পরে, কোট-প্যান্ট খুলতে গেলে চোখ জ্বালা করে। এই ধাঁধা বদলে যাবে তখন। দেশি পেঁয়াজের সমঝদার মানুষ আওড়াবে—বিদেশ থেকে এলেন সাহেব কোট-প্যান্ট পরে, কোট-প্যান্ট খুলতে গেলে বুকটা চচ্চড় করে।

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর