বরিশাল প্রতিনিধি : আরিফ আহমেদ দেশজুড়ে এখন আলোচনার ঝড় বরিশালের প্রশাসন ও সিটি মেয়র দ্বন্দ্ব । টেলিভিশনের প্রায় সব টকশোতেও এখন আলোচ্য বরিশাল। বলা চলে টক অফ টাউন এখন বরিশালের প্রশাসন ও মেয়র। যদিও ২২ আগষ্ট রাতে হয়েছে সমঝোতা। তবে যাকে ঘীরে যার বাসায় হামলার ঘটনায় মামলা, সেই ইউএনও মুনিবুর রহমান সমঝোতায় অনুপস্থিত ছিলেন।
এদিকে বরিশালবাসী অনেকে মনে করেন বরিশাল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের মধ্যে প্রশাসন ঢুকে পড়েছে। প্রশাসন ক্যাডারদের সভাপতি কবির বিন আনোয়ার পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব। আর এই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বরিশাল সদর আসনের এমপি জাহিদ ফারুক। প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মেয়রের সম্পর্ক সুখকর নয়, এ খবর বরিশালের রাজনীতিতে অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। ঘটনার দিন রাতে উপজেলা প্রশাসনের চত্বরে লাগানো শোক দিবসের ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণের জন্য সিটি করপোরেশন ও মেয়রের ব্যক্তিগত লোকজন যৌথ অভিযান চালায়। ওই পোস্টার ও ব্যানারগুলো ছিল প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের পক্ষ থেকে লাগানো। যা সরানো নিয়ে শুরু হয় এই তুলকালাম।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভন্ন সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও মেয়রের পিতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বরিশালের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যখন সক্রিয় ছিলেন, তখন তার সঙ্গে রেষারেষি ছিল প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরনের। হিরনের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী এমপি নির্বাচিত হলেও রাজনীতিতে শক্ত কোনো ভিত গড়তে পারেননি। এরপর আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ছেলেকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। অনেকটাই নতুন মুখ হিসেবে মেয়র পদে মনোনয়ন পেয়ে যান সাদিক আবদুল্লাহ। ছেলে নির্বাচিত হওয়ার পরে বরিশালের রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তালুকদার মোঃ ইউনুস, নঈমুল হোসেন লিটুসহ আরো কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, সদর আসন থেকে জাহিদ ফারুক এমপি নির্বাচিত হলেও তিনি নিজেকে দলীয় কাজে কখনোই মেলে ধরতে পারেননি।আর সাংসদ পক্ষের নেতারা বলেন, তার এই না পারার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে মেয়র সাদিক। বরিশাল আওয়ামী লীগের আর কাউকে মাথা তুলতে দিতে রাজী নন সাদিক। একইভাবে বরিশালের রাজনীতিতে আগে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকলেও এখন আর এ ব্যাপারে মনোযোগ নেই উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতাদের। মেয়র সাদিকের একক আধিপত্য বিস্তারের কারণে এসব সিনিয়র নেতাসহ আওয়ামী লীগের অনেকেই এখন বরিশালের রাজনীতি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। এমনকি তার পরিষদের অনেক কাউন্সিলরও এড়িয়ে চলেন তাকে।
অন্যদিকে বরিশাল সদর উপজেলা চত্বর থেকে শোকদিবসের ব্যানার অপসারনের পিছনে মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর একক আধিপত্য বিস্তার প্রধান কারন হলেও প্রশাসনের শক্ত অবস্থানে রয়েছে পূর্ব দ্বন্দ্ব। এছাড়া কাউন্সিলর মান্নার সাথে পুলিশের দ্বন্দ্ব যা থেকে মেয়রের সাথে দ্বন্দ্বে রূপ নেয়। প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীমের সাথে মেয়রের দ্বন্দ্ব সকলের জানা থাকলেও ১৮ আগস্টের ঘটনার পর তা প্রকাশ্য রূপ নেয়। মুলত ওই সকল কারনেই তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী আলোচিত ঘটনার জন্ম দিয়েছে বরিশালের রাজনৈতিক কতৃপক্ষ ও প্রশাসন ।
সুশীল সমাজের দাবি, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে যত দ্রুত সম্ভব এই দ্বন্দ্ব নিরসনের। তানা হলে ভোগান্তি পোহাতে হবে বরিশালবাসী সবাইকে। সিটি মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর সাথে জেলা প্রশাসনের প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় চলতি বছরের মে মাসে। এই দ্বন্দ্বের পেছনে কারন ছিলো দুটি। একটি হলো ত্রান ও দুর্যোগ ব্যবস্থা মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী বরিশালে ব্যক্তিগত সফরে আসেন। সেই বিষয়টি জেলা প্রশাসক মেয়রকে জানাননি। এতে ক্ষুব্ধ হন মেয়র। যা তার গতদিনের সংবাদ সম্মেলনেও প্রকাশ পেয়েছে। দ্বিতীয়ত মে মাসের আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় যারা সদস্য ছিলেন তারা ফুটপাত দখল ও করোনা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। ওই সভার রেজুলেশন মেয়রকে পাঠানোর কারণে জেলা প্রশাসকের উপর আরো ক্ষুব্ধ হন। এর আগে নিজের ফেসবুক লাইভে জেলা প্রশাসন ও পুলিশের উপর চরম ক্ষোভ ঝারেন মেয়র সাদিক।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দীন হায়দার সাংবাদিকদের বলছিলেন ‘ত্রান ও দুর্যোগ মন্ত্রী ঝালকাঠী এসেছিলেন তার বেয়াইর বাড়ীতে বেড়াতে। সেখান থেকে ব্যক্তিগতভাবে আমার বাসায় বেড়াতে আসেন। এটা মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সফর ছিল তাই তিনি (মন্ত্রী) আমাকে কাউকে জানাতে নিষেধ করেছিলেন। এ কারণে আমি কাউকে জানাইনি। যদি সরকারী সফর থাকতো তাহলে আমরা সবাইকে জানাতাম। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভার রেজুলেশন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মন্ত্রী, এমপি, মেয়রকে জানাতে হয়। তাই আমি সভার রেজুলেশন তাকে (মেয়র) পাঠিয়েছিলাম। এতে উনি (মেয়র) একটু মনোক্ষুন্ন হয়েছেন। যেহেতু উনি মনোক্ষুন্ন হয়েছেন তাই এখন থেকে তাকে আর জানাবো না আমাদের কাজ আমরা করবো বলে জানান জেলা প্রশাসক।
এরপর করোনাকালিন কঠিন লকডাউন সময়ে সরকার থেকে নগদ অর্থ ও চাল দেয়া হয়। যা জেলা প্রশাসক বন্টন করেন। এতেও ক্ষুব্ধ হন মেয়র। এ কারনে ওই টাকা ও চাল বন্টন করেন না তিনি। বিষয়টি জেলা প্রশাসক সাংবাদিকদেরও অবহিত করেন। পরবর্তীতে মেয়র ওই টাকা ও চাল বিতরণ করতে বাধ্য হন। পুলিশের সাথে মেয়রের প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের সূত্রপাত চলতি বছরের ২৭ মে। নগরীর ২১নং ওয়ার্ডের মানুমিয়ার লেনে জমি বিরোধের জেরে কোতোয়ালী মডেল থানার ওসি (অপারেশন) আনোয়ার হোসেনকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাউন্সিলর শেখ সাইয়েদ আহেমদ মান্না। যা মোবাইলে ধারন করে কে বা কারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছেড়ে দিলে তা ভাইরাল হয়।
পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৫ জনকে আটক করে। এ ঘটনার পর পর মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর বাসায় জরুরী সভা করে মহানগর আওয়ামীলীগ। সভায় মেয়র ও আওয়ামীলীগের নেতারা মান্নার পক্ষ নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে নানা ধরণের বিরূপ মন্তব্য করার কারনে পুলিশের সাথে বিরোধ দেখা দেয়। এছাড়া বিভিন্ন সময় মেয়র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক লাইভে এসে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে বিভিন্ন বিরূপ মন্তব্য করেছেন। সম্প্রতি একটি ভিডিওতে তাকে বলতে শোনা গেছে ‘আমার পুলিশ ও প্রশাসন কোনোটাই দরকার হয় না’। আমার কাজ আমি করি। আমি সাধারণ মানুষের ফোন ধরবো, তারা আমাকে নির্বাচিত করেছেন। আমিতো পুলিশ ও প্রশাসনের ফোন ধরতে বাধ্য না। এতে তার কাজে প্রশাসনকে নাক গলাতে নিষেধ করেন মেয়র সাদিক।ছোটখাটো এসব বিষয় নিয়ে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের সাথে বিরোধ সৃষ্টি হয়। আর এ বিরোধ নগরবাসী অবহিত। মেয়র লাইভে এসে বিষয়গুলো তুলে ধরতেন।
পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর সাথে মেয়রের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। যা সকলে অবহিত থাকলেও ১৮ আগস্ট রাতে প্রতিমন্ত্রীর শোকদিবসের ব্যানার নামাতে গিয়ে হামলা-মামলা হওয়ায় এখন তা প্রকাশ্যে চলে এসেছে। সদর আসন নগরবাসী ও সদর উপজেলাবাসী সকলে জোরেসোরেই বলে বেড়াচ্ছেন জাহিদ ফারুক শামিমের নেতৃত্বকে ধুলিসাৎ করতে তার ছবি সম্বলিত শোক দিবসের ব্যানার নামাতে গিয়ে যে অনাকাঙ্খিত ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে তাতে মেয়র সাদিকের একক আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি প্রকাশ পায়। জাহিদ ফারুক দমন মিশনে ইউএনও’র সাথে দ্বন্দ্ব এখন দেশ জুড়ে আলোচনার বিষয়। এমনকি শেষ পর্যন্ত মেয়রকে মামলা পর্যন্ত হজম করতে হয়েছে। সেই সাথে তার নেতাকর্মীরাও তার জন্য মামলায় জড়িয়ে কারাগারে রয়েছে। অনেকে আহত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। পাল্টা মামলা করার চেষ্টায় আদালতে অভিযোগ দায়ের করে মেয়রও তা প্রমাণ করে দিলো।
ঘটনার দিন উপজেলা পরিষদে থাকা জাহিদ ফারুক শামীমের বিলবোট ও ব্যানার অপসারন করতে গেলে বাধা দেন ইউএনও। তার বক্তব্য ছিল রাতের আধারে কেন, সকালে আসেন। এরপর যা ঘটেছে তা নগরবাসী থেকে শুরু করে দেশবাসী সকলে অবগত। কিন্তু সমস্যা সমাধানের নেই কোন উদ্যোগ। এ কথাগুলো বলেছেন নগরীর সুশীল সমাজের একাধিক নেতৃবৃন্দ। মেয়রসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দু’টি মামলা দায়েরের পর এবার ইউএনও এবং ওসি’র বিরুদ্ধে আদালতে নালিশি অভিযোগ দেয়া হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে বিরোধ আরো সৃষ্টি হবে। বিষয়টিকে যত দ্রুত সম্ভব সমঝোতার মাধ্যমে শেষ করা উচিত বলে মনে করছেন সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ। তানা হলে এ সমস্যার ভার বহন করতে হবে সাধারণ নগরবাসীকে।
বরিশাল বিভাগ উন্নয়ন পরিষদের সদস্য সচিব কামাল উদ্দিন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যত দ্রুত সম্ভব বিষয়টিকে মীমাংসায় আনা উচিত। তানা হলে জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সাথে প্রশাসন ও পুলিশের দ্বন্দ্বে উন্নয়ন কর্মকান্ড ব্যহত হওয়ার সাথে সাথে নগরবাসীকেও সমস্যায় পড়তে হবে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সাধারন সম্পাদক রফিকুল আলম বলেন, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র কের যে উদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা সমাধান যোগ্য। এ ক্ষেত্রে সুশীল সমাজকে দায়িত্ব দেয়া হলে তারা এগিয়ে আসতে আগ্রহী। তিনি আরো বলেন, প্রশাসনিক ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয় ছাড়া উন্নয়ণ থেকে শুরু করে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন সুষ্ঠু পরিচালনা সম্ভব নয়। যে সমন্বয় করতে বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি একলানীতিতে চলায় এবং তার দাম্ভিকতার তাকে আজকে এ অবস্থায় ফেলেছে।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন হায়দার কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি।
তবে একাধিক সংবাদ সম্মেলনে সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ বলেছেন, আমার বিরুদ্ধে একটা গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। আমি সব বুঝি। প্রশাসনের পিছনেও কেউ কলকাঠি নাড়ছেন। সবই একদিন প্রকাশ পাবে। মাহনগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি প্যানেল মেয়র-১ গাজী নঈমুল হোসেন লিটু বলেন, ১৮ আগস্টের ঘটনার পর যা কিছু প্রচার চালানো হচ্ছে তা নগরবাসীকে বিভ্রান্তি করার জন্য। নিজেদের দোষ ঢাকার জন্যই তারা এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। প্রতিমন্ত্রীর সাথে দ্বন্দ্ব তাও সঠিক নয়। এটাও একটা অপপ্রচার। মেয়র তিনিও প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদার। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এ জন্য মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহকে হত্যার চেষ্টা চালানোর বিষয়ে যারা এর সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আদালতে নালিশি অভিযোগ দিয়েছি। সর্বশেষ আদালত আবেদন আমলে নিয়ে পিআইবিকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। অপরদিকে পুলিশের তদন্ত নয়, বিচার বিভাগীয় তদন্ত চান বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগ ও মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ।